এই মুহুর্তে কোনো এক উচ্চাকাঙ্খী শিক্ষক, রচনা করছেন একটি ৬০ পাতার প্রবন্ধ, সেকেলে কোনো শিক্ষাতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে, যেটি হয়ত কোনো এক মৃত শিক্ষাবিদের মস্তিস্ক-প্রসূত, আর ভাবছেন তার এই কাজটি, যা নিয়ে তিনি এখন ব্যস্ত, আদৌ জড়িত কিনা তার নিজের ইচ্ছে বা স্বপ্নের সাথে; শিক্ষক হিসেবে তার ইচ্ছে, জীবন বদলে দেওয়ার, জীবনে জাদুর ছোঁওয়া আনার ইচ্ছে। এই মুহূর্তে কোনো এক অভিকাঙ্খী শিক্ষক, কোনো এক শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, শুনছেন কোনো এক অধ্যাপকের অবিরাম বকবকানি ছাত্রদের আগ্রহ ধরে রাখার বিষয়ে, অত্যন্ত ক্লান্তিকর, বিচ্ছিন্ন এক ভাষণে। এই মুহূর্তে একজন নতুন পাশ করা শিক্ষক পাঠ পরিকল্পনা করছেন, বুঝতে চেষ্টা করছেন শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন মান বা পরিমাপ বুঝতে চেষ্টা করছেন ছাত্রদের যথাপোযুক্ত মূল্যায়ন কীভাবে করা যায় এবং ভাবছেন বারে বারে, 'নভেম্বর অবধি বেশী হাসিখুশী ভাব দেখান যাবে না,' কারণ তাঁকে এমনই শেখানো হয়েছিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এই মুহূর্তে কোনো এক ছাত্র ভাবছে কী ভাবে তার অভিভাবকদের বিশ্বাস করানো যায় যে সে অসুস্থ, গুরুতর অসুস্থ আর তাই, আগামীকাল সে স্কুলে যেতে পারবে না। অন্য দিকে, ঠিক এই মুহূর্তে আছেন এমন অনেক প্রতিভাবান শিক্ষক যাঁরা তথ্য বিতরণ করছেন, এমন আকর্ষণীয়, আগ্রহ-উদ্দীপক বিতরণ, যে বিমহিত ছাত্ররা একেবারে তাদের আসনের প্রান্তে চলে এসেছে, অপেক্ষা করছে কখন এক বিন্দু ঘাম এই ব্যক্তিটির কপাল থেকে চুঁইয়ে পড়বে, আর তারা তাঁর জ্ঞান নিজেদের মধ্যে শুষে নেবে। এই মুহূর্তে আছেন আর এক ব্যক্তি যাঁর সামনে রয়েছেন মনোযোগী দর্শকবৃন্দ, এমন এক ব্যক্তি যিনি শোনাচ্ছেন এক বিস্ময়কর বৃত্তান্ত এমন এক জগতের যার কথা সমবেত দর্শকেরা কোনোদিন কল্পনা করেননি বা শোনেননি। তবুও চোখ বুজলে, তাঁরা সহজেই কল্পনা করে নিতে পারেন এই জগত কারন গল্প বলার কায়দাটি চিত্তাকর্ষক। এই মুহূর্তে আছেন এমন এক ব্যক্তি যিনি দর্শকদের বলতে পারেন হাত তুলতে এবং তাদের হাত তোলা অবস্থাতেই রাখতে যতক্ষণ না তিনি বলছেন, "এবার হাত নামিয়ে নিতে পারেন।" এই মুহূর্তে। লোকে তখন বলতেই পারে যে "ক্রিস, তুমি এমন লোকের কথা বললে যাঁরা এক ক্লান্তিকর, উদ্দীপনাহীন শিক্ষন পাঠক্রমের শিকার আবার তাঁদের কথাও বললে যাঁরা মনগ্রাহী শিক্ষাপ্রদানের মাধ্যমে ছাত্রদের আগ্রহ বজায় রাখেন। শিক্ষা জগতের কথা ভাবতে গেলে, বিশেষত শহুরে শিক্ষা ব্যাবস্থার কথা ভাবলে, দেখা যাবে যে এই দুই রকমের শিক্ষকেরা পরস্পর কে বাতিল করে দেবেন, সুতরাং, এদের থাকা না থাকা মোটের ওপর প্রভাবহীন।" তবে প্রকৃতপক্ষে, আমি যাদের কথা বলছিলাম, দক্ষ নিয়ন্ত্রনকারী শিক্ষক হিসেবে, দক্ষ আখ্যান-নির্মাতা হিসেবে, এই সুদক্ষ গল্প-বলিয়েরা সাধারণ ক্লাসরুম থেকে অনেক দূরে। যাঁরা শিক্ষাদানের নিপুণ কলায় সুদক্ষ, যাঁরা পারেন শ্রোতাদের মনোযোগ রাখতে, তাঁরা জানেনই না শিক্ষক প্রশিক্ষনের বিশেষ পাঠক্রম বা সার্টিফিকেট কী। এমন কী, হয়ত তাঁদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়-প্রদত্ত এমন কোনো উপাধিও নেই যাতে আনুষ্ঠানিক ভাবে বলা যায় যে তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে। আমার কাছে, এটা অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার। দুঃখ এই জন্য, কারণ এঁরা শিক্ষাগ্রহনের প্রক্রিয়ায় বিশেষ আগ্রহী নন, তবু এরা দক্ষ ও কার্যকরী শিক্ষক হতে চান, কিন্তু অনুকরণীয় কোনো আদর্শ নেই এদের জন্য। এই প্রসঙ্গে আমি তুলে ধরতে চাই মার্ক টোয়েনের বক্তব্য। টোয়েন বলতেন, সঠিক প্রস্তুতি অথবা শিক্ষাদান, এতটাই প্রভাবশালী হতে পারে যে দুর্বল নীতিবোধের মানুষও নৈতিক দৃঢ়তা গঠন করতে সক্ষম হয়, দুরাচার সদাচারে বদলে যেতে পারে, মানুষের মনে আমূল পরিবর্তন আসতে পারে, রুপান্তর হতে পারে মানুষ দেবদূতে। যাঁদের কথা আমি একটু আগে বলছিলাম, তাঁরা শিক্ষাদানে যথাযথভাবে তৈরী, তবে কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে নয়, বরং আগ্রহ-উৎপাদনকারী জায়গাগুলিতে তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে। বলুন দেখি, এমন জায়গাগুলি কোথায়? নাপিতের দোকানে, র্যাপ কন্সার্টে, আর খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে, পাবেন কৃষ্ণাঙ্গদের গির্জায়। আমি পেন্টেকোস্ট-অনুপ্রাণিত শিক্ষনবিজ্ঞান নিয়ে কিছু চিন্তা ভাবনা করেছি। আপনাদের মধ্যে ক'জন কৃষ্ণাঙ্গদের গির্জায় গেছেন? দু একজনের হাত দেখতে পাচ্ছি। কৃষ্ণাঙ্গদের গির্জায় তাদের যাজক প্রায়শই ধর্ম নির্দেশনা শুরু করতে গিয়ে খেয়াল করেন যে আগে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে, সুতরাং তিনি প্রায়ই শব্দক্রীড়াচ্ছলে শুরু করেন তাঁর বক্তব্য প্রথম প্রথম, আর তারপর তিনি কয়েক মুহূর্তের স্বল্প বিরতি নেন, আর খেয়াল করেন, "এ কী! এরা তো দেখি এখনো পূর্ণ মনোযোগ দেয়নি আমার কথায়।" সুতরাং তিনি বলে ওঠেন, "সবাই বলুন দেখি, আমেন?" শ্রোতাবৃন্দঃ আমেন ক্রীস এমডীনঃ আমেন বলুন, শুনি। শ্রোতাবৃন্দঃ আমেন। ক্রীস এমডীনঃ সহসা, শ্রোতারা সবাই আবার সজাগ। যাজক শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য তাঁর সামনের বেদীটিতে হা্ত ঠুকে আওয়াজ করতে থাকেন, কথা শুরু করেন অত্যন্ত নীচু স্বরে, যখন তিনি চান যে শ্রোতারা তাঁর কথায় মনোনিবেশ করুক। আর ঠিক এমন দক্ষতাই চাই আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে, ছাত্রদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য। তবে কেন শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাঠক্রমগুলিতে শুধুই তত্ত্ব পড়নো হয় শুধুই মানদন্ড ও গুনাগুন পরিমাপকের আলোচনা হয় যার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক দক্ষতার, সম্পর্ক নেই সেই জাদুর যার দ্বারা শ্রোতাদের অথবা ছাত্রদের আগ্রহ ধরে রাখা যায়? তাই আমার বক্তব্য হল, শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাঠক্রমের মূল কাঠামোটির পরিবর্তন করা দরকার, পাঠ্যসূচীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব থাকুক, ক্ষতি নেই, তাত্ত্বিক আলোচনারও গুরুত্ব থাকুক, ক্ষতি নেই, তবে শুধু পাঠ্যসূচী বা শুধু তত্ত্ব আলোচনা সফল শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের জাদুর অভাবে অনেকটাই অর্থহীন। লোকে বলে, "জাদু তো কেবল ভোজবাজি, আর কিছু নয়।" এমন শিক্ষকও আছেন যাঁরা বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাঁদের এই বিশেষ দক্ষতা নিয়ে স্কুলে পড়ান, ও সফল ভাবে ছাত্রদের আগ্রহ ও মনোযোগ ধরে রাখেন। তাঁদের দেখে প্রশাসনের কর্তারা বলেন "বাহ! ইনি তো বেশ ভালো পড়ান! স্কুলের বাকি শিক্ষকেরাও তার মত দক্ষ হলে মন্দ হত না।" যখন এমন শিক্ষকের এই বিশেষ দক্ষতার বিবরণ দিতে অনুরোধ করা হয়, উত্তর আসে, "উনি জাদু জানেন।" কিন্তু আমার বক্তব্য হল, এই জাদুবিদ্যে সমস্ত শিক্ষকদের শেখানো সম্ভব। এ জাদু শেখানো সম্ভব। জাদু শেখানো সম্ভব। প্রশ্ন হল, কীভাবে? উপায় হল লোককে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া যেখানে এমন জাদু ঘটছে। আপনি যদি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন উচ্চাভিলাসী শিক্ষক হতে চান তাহলে আপনাকে বের হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের গন্ডি ছেড়ে আর পা রাখতে হবে পাড়ায়। ঘুরে আসুন পাড়ার নাপিতের দোকানে ঘুরে আসুন কোনো কৃষ্ণাঙ্গের গির্জায় আর ভাব করুন ওই মানুষগুলির সাথে যারা পারেন দর্শকদের অংশগ্রহণে আগ্রহী করতে। লক্ষ্য করুন তারা কী করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক-প্রশিক্ষণ ক্লাসে আমি একটি প্রকল্প শুরু করেছি, যাতে প্রতিটি ছাত্র সেখানে এসে বসে র্যাপ কন্সার্ট দেখে। তারা দেখে র্যাপাররা স্টেজে কীভাবে ঘোরেফেরে কীভাবে তাঁরা তাঁদের অঙ্গ সঞ্চালনের মাধ্যমে কথা বলেন। ছাত্রেরা লক্ষ্য করতে শেখে কীভাবে র্যাপাররা স্টেজে সগর্বে হাঁটেন। তারা শোনে এরা কীভাবে বিভিন্ন রূপক ও অলঙ্করণের দ্বারা সাদৃশ্যের উপস্থাপনা করেন। এভাবে ছাত্রেরাও শিখতে শুরু করে এই কৌশলগুলি। ক্রমাগত আনুশীলনের ফলে এই কৌশলগুলিই জাদুখেলার চাবিকাঠি হয়ে ওঠে। তারা বুঝতে শেখে যে একটি ছাত্রের দিকে কেবল স্থির দৃষ্টিতে ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে থাকতে পারলে, একটি শব্দ পর্যন্ত বলার প্রয়োজন হয়না। কারন ছাত্রেরা জানে, যে এর মানে আপনি চান আরও বেশী। আমরা যদি শিক্ষক প্রশিক্ষণের আমূল রূপান্তর করতে পারি, শিক্ষদের এই বিশেষ জাদুশিক্ষায় পারদর্শী করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে, তাহলে ছু-মন্তর! নির্জীব ক্লাস হবে মূহুর্তেই সজীব। এ ভাবে আমরা পারব সুপ্ত কল্পনাশক্তি আবার জাগ্রত করতে, শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে। ধন্যবাদ। (করতালি)