প্রশ্নের সম্মুখে ...চিত্রকলা দুজন পুরুষ জিনিষে ঠাসা তাক বা সেল্ফের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন৷ হোলবাঁর আঁকা চিত্র! আপাতদৃষ্টিতে সবকিছুই বিলাসিতা, ক্ষমতা, ঔদ্ধত্তের পরিচায়ক বলে মনে হয়৷ কিন্তু এসবের মাঝে কী যেন একটা বেসুর ঠেকে! সেটি হল একটি ম্লান ও ভয়ঙ্কর আকৃতি যা তাদের নীচে ঝুলে আছে... চিত্রটির মর্মার্থ আবিষ্কার করতে হলে, একে কোণ থেকে দেখতে হবে: যখন আমরা এই পন্থা অবলম্বন করি, চিত্রের মধ্যে নিপুণভাবে পেতে রাখা ফাঁদ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় এবং প্রকৃত সত্য প্রকাশ পায়! মৃত্যু সবকিছু নিঃশেষ করে দেয়! অতএব অতি নিপুণতার সঙ্গে আঁকা এই চিত্রটির প্রকৃত অর্থ কি? এই দুই পুরুষ কি মৃত্যুকে পদদলিত করছেন.... ...নাকি তাঁরা মৃত্যুকে জয় করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ? পর্ব ৬ : হোলবাঁর আঁকা "রাষ্ট্রদূতগন" "মৃত্যুর বিরুদ্ধে কি আমরা জয়ী হতে পারি ?" প্রথম অ্যাক্ট : অপরাজেয় মৃত্যু মৃত্যুকে পরাজিত করার প্রয়াস করা ? সেক্ষেত্রে এই দুই ব্যাক্তি একেবারেই প্রস্তুত নন বলে মনে হয়! বিস্তর পোষাকে ঢাকা শরীর... ...এলোমেলোভাবে থাকা জিনিষপত্র... ...মোটিফের জটলা: এই কৃত্রিম, বিষণ্ণ, জটিল মানবজীবনের সামনে... ...মৃত্যুকে অতীব সজীব দেখায়! এই চিত্রের একমাত্র স্বাভাবিক ও অকৃত্রিম বস্তু হল মৃত্যু, একমাত্র মৃত্যুই এক বিশেষ আলোকে উদ্ভাসিত যা চিত্রটির ডানপ্রান্ত থেকে,... ...এবং এর নিজস্ব তেরছা কোণ থেকে আসছে৷ এমনকী এই মৃত্যুকে যেন জয়ীর হাসি হাসতেও দেখা যায়... ....চিত্রে মৃত্যুর এই হাসি তার চোয়াল থেকে কান অবধি বিস্তৃত৷ মৃত্যুকেই এই চিত্রে প্রকৃত হিরো / নায়ক বলে মনে হয়! প্রাথমিকভাবে, "রাষ্ট্রদূতগন"এর পর্যবেক্ষণ করার ফল হল একাধারে সহজ ও উপদেশমূলক : একদিকে, মৃত্যুর দৃষ্টিকোণ,... ...যা জাগতিক বাস্তবতার অসারত্বকে মেলে ধরে : না প্রাচূর্য, না ক্ষমতা, এমনকী না জ্ঞান, কোনোকিছুই আমাদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে না! অপরদিকে, এক উল্লম্ব দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রটি দেখলে যীশুর প্রায় অদৃশ্য একটি ছবি একেবারে ক্যানভাসের ডান কোণায় দেখা যায় যাঁর উপস্থিতি যেন মৃত্যকে " মুছে "দেয় : অর্থাৎ শিল্পী এখানে ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকেও চিত্রটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ হোলবাঁ তাঁর চিত্রটি ক্যানভাসের বিভিন্ন কোণ থেকে ব্যাখ্যা করার জন্য ক্যানভাসের চারপাশে দর্শকদের নড়াচড়াকে অত্যন্ত নিপূণতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন যাতে দর্শক এখানে তাঁর দৈহিক চলাফেরার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক চলন সম্পর্কেও অবহিত হন: যা জাগতিক জগৎ থেকে সরে গিয়ে প্রথমে ঈশ্বর ও তারপরে তাঁকে মুক্তির পথে নিয়ে যাবে৷ কিন্তু এই চিত্রের পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা এখানেই শেষ হয় না! কারণ এখানে আরও অন্তর্নির্হীত অর্থ উন্মোচন করার আছে: এই অন্তর্নিহীত অর্থ খোঁজার প্রয়াস আমাদেরকে ক্যানভাসের খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি মনযোগী হবার জন্য উৎসাহিত করে, বিশেষ করে H আকৃতির উপরে থাকা তাকটির প্রতি যাতে এই দুই রাষ্ট্রদূত হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ তাঁরা যেন মৃত্যুর উপর তাঁদের কতৃত্ত্ব স্থাপন করেছেন: কী তাঁদের এহেন "দুরহঙ্কার" করার ক্ষমতা দেয়? দ্বিতীয় অ্যাক্ট : " রাজনৈতিক মৃত্যু " ১৫৩৩ : দুই রাষ্ট্রদূত৷ তাঁরা নবীন : তাঁদের একজনের বয়স একটি ছুরিতে গোপনীয়তার সঙ্গে উল্লিখিত আছে, ২৯ বছর এবং অপরজনের বয়স : একটি বইয়ে, ২৫ বছর৷ তাঁরা ফরাসী : আমরা ফ্রান্সের রাজার তৈরী সন্ত মিশেলের আদেশ দেখতে পাই... ...এবং উভয়ই কূটনিতির পেশায় একই দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করেন,... ...এই দৃষ্টিভঙ্গী চিত্রের তাকে রাখা জিনিষগুলি দেখলে বোঝা যায়৷ তাকের উপরদিকে,উৎকর্ষতা - ঐশ্বরিক শৃঙ্খলা তাকের নীচের অংশে, বিশৃঙ্খলা - পার্থিব জগতের প্রতিচ্ছবি, অশুভ সঙ্কেতের চিহ্ন দ্বারা পরিবেষ্টিত : কেসের মধ্যে একটি বাঁশী নেই - তারের বাদ্যযন্ত্রটির একটি তার ছিঁড়ে গেছে - গণিত বইএর "ভাগের" পৃষ্ঠাটি খোলা - এবং সবশেষে তাকের মেঝেতে উল্টে থাকা ভূগোলক৷ এ সবকিছুই এক সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে : ইউরোপের বিভিন্ন শক্তির সম্পর্কের পরিবর্তন,... যা একটি দেশের অস্তিত্ত্বকে বিপন্ন করে ও তার শত্রুপক্ষকে ক্ষমতাশালী করে, এই দেশটি হল ফ্রান্স, তখন ইউরোপের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দেশ৷ পর্তুগাল ও কাস্তি পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্য গড়ছে এবং পোপের আশীর্বাদে,তারা পৃথিবীকে নিজেদের ক্ষমতার বলে কুক্ষীগত করছে ও সাম্রাজ্যের পরিধি/সীমানা বিস্তার করছে : এই সীমানার পূর্বদিকে যে নতুন জাযগাগুলি আবিষ্কৃত হয় সেগুলি পর্তুগালের অধীনে আসে, আর পশ্চিমপ্রান্তেরগুলি স্পেনের দখলে যায়৷ পরিস্থিতি আরও জটিল হয় যখন কাষ্তি ও আরাগঁ ফ্রান্সের চিরশত্রু জার্মানীর রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়ে পড়ে... এবং ইংরেজরা তখনও কালেতে উপস্থিত৷ ফলস্বরূপ ফ্রান্স চতুর্দিক থেকে কোণঠাসা হয়ে পড়ে৷ সুতরাং তাকে বাঁচাবার জন্য রাষ্ট্রদূতরা ৩ টি চাল চালেন : প্রথম চাল, যার রূপকার প্রোটেস্টানিজমের প্রতিষ্ঠাতা লুথারের এই শ্লোক : খ্রীষ্টধর্মের দুইভাগে বিভাজন : ক্যাথলিক ও প্রোটেষটান্ট৷ প্রোটেষ্টান্ট প্রিন্স ও শহরগুলিকে সমর্থনের মাধ্যমে তাঁরা সাম্রাজ্যকে দূর্বল করে দেন, সেই সাম্রাজ্য যা ইতিমধ্যেই সহস্র স্টেটে বিভক্ত হয়ে পড়েছে৷ দ্বিতীয় চাল, মুসলিম জগতের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করা, যার প্রমাণ আমরা চিত্রের কার্পেটের মধ্যে পাই৷ যখন এই চিত্রটি আঁকা হয়েছিল, ওটোমান সাম্রাজ্য ভিয়েনার দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে এবং খ্রীষ্টধর্মকে ভীতিপ্রদর্শন করে৷ কিন্তু রাষ্ট্রদূতরা তৎসত্ত্বও তার সাথে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন... ...যাতে সাম্রাজ্যের শক্তিকে ফ্রান্সের পূর্বপ্রান্তে সরিয়ে দেওয়া যায়৷ তৃতীয় চাল : ইংল্যান্ডের রাজার প্রেম জীবন, যার প্র্রতীকস্বরূপ চিত্রের মেঝের টাইলস আমরা দেখতে পাই. এইই টাইলস লন্ডনের ওয়েষ্টমিন্সটার অ্যাবের টাইলসকে অনুকরণ করে৷ এই ওয়েষ্টমিন্সটার অ্যাবেতেই ফরাসিদের সহায়তায় ইংল্যান্ডের রাজা ইংরেজ আন বোলেনকে বিবাহ করেন তাঁর প্রথম স্ত্রীকে পরিত্যাগ করার পর, যিনি সাম্রাজ্যের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত ছিলেন৷ এই কৌশলের মাধ্যমে ইংল্যান্ড ও সাম্রাজ্যের মধ্যে সম্ভাব্য আঁতাতকে ফ্রান্স রোধ করে৷ সুতরাং"রাষ্ট্রদূতগণ" চিত্রটি এক নতুন ধর্মকে প্রতিফলিত করে৷ এমন এক ধর্ম যা পোপের বিরুদ্ধাচরণ করতে , খ্রীষ্টধর্মের বিরুদ্ধ যেতে ও সাম্রাজ্যের বিপক্ষে জোটবদ্ধ হতে প্রশ্রয় দেয়: তখন, যখন একটি দেশের অতীব গুরূত্ত্বপূর্ণ স্বার্থ বিপদের সম্মুখীন হয় : রাজনীতি ও রেইসঁ দেতা (Raison d'Etat)৷ এটি ম্যাকিয়াভেলির মত যা তাঁর রচিত " দ্য প্রিন্স " বইটিতে পাওয়া যায়৷ এই চিত্রটি আঁকার এক বছর আগে ম্যাকিয়াভেলির বই "দ্য প্রিন্স" প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি দেখান যে রাজনীতি তার নিজস্ব আইন মেনে চলে৷ " [ দ্য প্রিন্স ], তাঁর রাষ্ট্রকে চালানোর জন্য প্রায়ই মানবতার বিরুদ্ধাচরণ করেন, দানশীলতার বিপক্ষে, এমনকী ধর্মের বিরুদ্ধেও যান৷ শাসককে যথাসম্ভব নৈতিক উৎকর্ষতার পথে চলা উচিত, কিন্তু প্রয়োজনমত তাঁকে অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করতেও জানতে হবে৷ " " রাষ্ট্রদূতগন " মূলত ৩ টি মুভমেন্টের উপর বিশেষভাবে আলোকপাত করে : - আধ্যাত্মিক মুভমেন্ট, যেখানে বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটছে,... যা পার্থিব জগৎ ও অহংকারের পথ থেকে মানুষের দৃষ্টি ঈশ্বরের প্রতি আকৃষ্ট করে৷ রাষ্ট্রদূতদের গতিবিধি / মুভমেন্ট যা সংঘাতের পরিস্থিতিকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগে রূপান্তরিত করে৷ - শৈল্পিক মুভমেন্ট : হোলবাঁ তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের প্ররোচিত করেন... ..তাঁর ক্যানভাসের চারপাশে আমাদর নড়াচড়ার মাধ্যমে জীবন নিয়ে মায়াজাল বুনতে ও সেই জাল ছিঁড়তে৷ জীবন ও মৃত্যু একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত: আমাদের তা মেনে নিতে হবে... ...নয়ত ধ্বংস হয়ে যেতে হবে! "রাষ্ট্রদূতগণ" চিত্রটিতে আরও রহস্য লুকিয়ে আছে! সম্পূর্ণ ভিডিওটি দেখতে আগ্রহী ব্যাক্তিরা এটি ডিভিডি ও ভিওডিতে পেতে পারেন পরবর্তী কাহিনী : বেল্লিনীর আঁকা "স্বর্গীয় প্রকৃতি"! অতিরিক্ত তথ্যের জন্য যোগাযোগ করুন : www.canal-educatif.fr রচনা ও পরিচালনা: প্রযোজনা: আর্থিক সহায়তা : স্পনসর / পৃষ্ঠপোষক ও জনগণের সমর্থন ভয়েসওভার ভিডিও এডিটিং এবং গ্রাফিক্স পোষ্ট - প্রোডাকশন / সাউন্ড রেকর্ডিং যন্ত্রানুসঙ্গ নির্বাচন সঙ্গীত কৃতজ্ঞতা : বাংলা অনুবাদ : অর্পিতা দত্ত একটি CED এর উপস্থাপনা